একসময় বাঁচিয়েছেন লক্ষাধিক মানুষের প্রাণ! যোগ্য সম্মানের অভাবে লোকচক্ষুর আড়ালেই ভারতীয় মহান বিজ্ঞানী শম্ভুনাথ দে
যে মাটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাশ, জগদীশচন্দ্র বোস, প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ঈশ্বরের আশীর্বাদ হয়ে এসেছিলেন। সেই মাটিতেই স্বয়ং ঈশ্বরও মাঝেমধ্যে বঞ্চিত হন। সেই ঈশ্বর পাননি যোগ্য সম্মান। দেশকে সম্মান না করার জন্যই অনেকেই দেশেরই খেয়ে পড়ে বড় হয়ে বিদেশে চলে যায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য। একবারও ভেবে দেখে না দেশের মানুষগুলোর কি হবে। তবে এর ব্যতিক্রম রয়েছে প্রচুর। যারাই ব্যতিক্রম হিসেবে রয়েছে তারাই আজ সম্মানের আলো থেকে বঞ্চিত।
ডাক্তার শম্ভুনাথ দে, কলকাতা থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে গাড়ি বাড়ি গ্রামে ১৯১৫ সালের ১৫ ই এপ্রিল এমনই একজন বিজ্ঞানীর জন্ম, যিনি এক সময় লক্ষেরও বেশি মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছেন। কিন্তু এক ফোটাও সম্মান জোটেনি তার কপালে। যদিও এনাদের মত মানুষ আশা করতেন না সম্মানের তবুও প্রত্যেক দেশবাসীর উচিত তাদের সম্মান জানানো। বাবা ছিলেন পেশায় এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। স্কলারশিপের টাকাতেই ক্যালকাটা মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করেছিলেন তিনি। পরে লন্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলেরায় লক্ষাধিক ইউরোপের মানুষের মৃত্যু হয়েছিল তখন তিনি কলকাতায় ইনস্টিটিউশনের হয়ে কাজ করেছিলেন। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০ সাল অব্দি নানারকম গবেষণা চালিয়ে তৈরি করেছিলেন কলেরার টক্সিন।
১৯৫০ সালে যখন কলেরা মহামারী জেরে সকলের প্রাণ ওষ্ঠাগত ঠিক সেইসময় কলকাতা থেকে পাশ করে এই বিজ্ঞানী ক্রমাগত দিনরাত এক করে খুঁজেছিলেন কলেরার টক্সিন। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তিনি হদিশ পান কলেরা রোগের অন্যতম মারণ কারণ হলো মানব শরীরের ডিহাইড্রেশন। অর্থাৎ শরীরের জল কমে যাওয়া। এই কারণ আবিষ্কার করা মাত্রই তিনি এমন টক্সিন আবিষ্কার করলেন যেটি মানব শরীরে চাহিদা মেটাবে জলের। ভারতবর্ষের জন্য তার অবদান অপরিসীম কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাকে সম্মানিত করা হয়নি কোনদিনই। তবে আধুনিক চিকিৎসা স্বাস্থ্য সাদরে তার এই অবদানকে গ্রহণ করেছে।
কলেরা টক্সিনের আবিষ্কারের পর যোগদান করেছিলেন নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে। রবার্ট কোচ একসময় লিখেছিলেন, “কলেরা নিয়ে যারা গবেষণা করছেন তাদের দেশে কলেরা নেই বললেই চলে। অথচ ভারতের মতো দেশে যেখানে প্রচুর কলেরা রোগী, সেখানে কলেরা নিয়ে গবেষণা তেমন কেউই করেন না।” যেখানে সবাই মনে করতেন কলেরার ফলে অন্ত্রের দেয়ালে যে পিচ্ছিল পদার্থ দ্বারা আবৃত আবরণী রয়েছে তা নষ্ট করে কলেরার জীবাণু সবখানে ছড়িয়ে পড়ছে, একটা গৌণ উপসর্গ তা। কিন্তু এই ধারণা পাল্টে দিয়েছিলেন শম্ভুনাথ দে। বছরের পর বছর চলতে থাকা এই ধারণার বিরুদ্ধে নতুন ধারণা প্রবর্তন করে বলেছিলেন বিষটি এন্ডটক্সিন নয় এক্সটক্সিন।
১৯৭৩ সালে চাকরি থেকে অবসর নেন। গবেষণার জীবনে যোগ্য সম্মান এবং গবেষণার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহযোগীতা একেবারেই না পাওয়ায় সবমিলিয়ে তিনি ভীষণভাবে শেষের দিকে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। তবে নোবেল ফাউন্ডেশন এর উদ্যোগে ১৯৭৮ সালে অনুষ্ঠিত বক্তৃতা সম্মেলন তার মানসিক ভাবে কিছুটা শক্তি ফিরিয়ে দিয়েছিল। এর পরে তিনি পুনরায় যুক্ত হন গবেষণার সঙ্গে। উপযুক্ত স্বীকৃতি না পেয়ে অবহেলায় গবেষণার জন্য ঠিকমতো কাজ চালাতে না পারলেও কোন কারনেই দমে যাননি তিনি। ১৯৮৫ সালে এপ্রিলে অধ্যাপক মৃত্যুবরণ করেন।