সমালোচনাকে আমল দেন না মোনালি ঠাকুর, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে উপভোগ করেন বাঁচার আনন্দ!
শৈশব কেটেছে চরম অর্থাভাবে। পেরিয়ে এসেছেন দীর্ঘ অবসাদ। কনে বেশে অপেক্ষা করেছেন রেজিস্ট্রেশন অফিসে। জানেন তিনি কে? নাম শুনলে চমকে যাবেন আপনিও।
মোনালি ঠাকুর, ছোট্টখাট্ট মিষ্টি চেহারার এই মেয়েটির গলা না শুনলে, যেন পুজোর আমেজ ঠিক জমে না। এই পুজোতেও তাঁর গাওয়া গান ‘দুগ্গা এলো’ তে রীতিমত মেতে উঠেছেন আট থেকে আশি সকলেই। গত ৩ রা নভেম্বর ছিল গায়িকার জন্মদিন। ৩৮ বছরে পা দিলেন তিনি।
বলিউডে ২০০৬ সালে তিনি প্রথম প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে অভিষেক ঘটালেও, তাঁকে জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল ২০০৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘রেস’ ছবিটি। সঙ্গীত পরিচালক প্রীতম চক্রবর্তীর সুরে দুটি গান গেয়েছিলেন মোনালি। ব্যাস, তখনই গায়িকার জীবনে আসে টার্নিং পয়েন্ট। আস্তে আস্তে মোনালির সাফল্যের মুকুটে জুড়তে থাকে একের পর এক পালক।
যদিও মোনালির এই সাফল্যের শিখর ছোঁয়া, মোটেই সুগম ছিল না। কথায় বলে, পথ যত কঠিন, জয়ের আনন্দ তত বেশি! মোনালির জীবনেও ঘটেছিল তাই। আজকের মোনালি হয়ে ওঠার জন্য তাঁকে পেরোতে হয়েছে দীর্ঘ চড়াই উৎরাই পথ। মোনালির বাবা শক্তি ঠাকুর ছিলেন বাংলা ছবির জগতের এক উজ্জ্বল নাম।
তাঁর সঙ্গে পরিচয় ছিল বাংলার গুণী শিল্পীদের। কিন্তু বাবার পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে তাঁর মেয়েরা পরিচিত হবেন, সেই পথে কখনওই সন্তানদের চালনা করেননি শক্তি ঠাকুর। এমনকী নিজেও আখের গুছিয়ে নেওয়ার জন্য, নিজের পরিচয়ের সুযোগ নেননি তিনি। ফলে আর পাঁচজন অতি সাধারণ পরিবারের মতই নিজের পরিবারের ত্রাতা হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
কিন্তু বাধ সাধে চরম অর্থকষ্ট। দেনার দায়ে জর্জরিত হন ঠাকুর পরিবার। তবুও সৎ পথে থেকেই, দুই সন্তান মেহুলি এবং মোনালিকে মানুষ করেন তিনি।
আরও পড়ুন : রবীন্দ্র কবিতার পর এবার নজরুলগীতিতে স্বরচিত সুর প্রয়োগ করে কাঠগড়ায় এ.আর.রহমান
ছোট থেকেই পড়াশুনার সঙ্গে নানা রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন মোনালি। হিপহপ, ভারত নাট্যমসহ সালসাতেও ছিল তাঁর দারুন চর্চা। বলা বাহুল্য, গানের দিকেও ছিল তাঁর আলাদা ভক্তি। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী কৌশিকী দেশিকানের কাছেও তালিম নেন মোনালি।
গান গাইবার জন্য যেকোনও সীমা অতিক্রম করতে পারতেন ‘সাওয়ার লু’ র গায়িকা। এমনকী মাঝ পথে কলেজ ছেড়ে, পাড়ি দেন মায়ানগরী মুম্বাইয়ে। চেয়েছিলেন নিজের ভাগ্য বদলাতে। ২০০৪ সালে যোগ দিয়েছিলেন জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো ‘ইন্ডিয়ান আইডল’ এ। যদিও, টপ এইটে জায়গা করে নিতে পারেননি আজকের জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত গায়িকা।
ইন্ডিয়ান আইডলের মঞ্চ থেকে বিদায় নিয়ে, তীব্র অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন মোনালি। তিনি জানান, মঞ্চে উঠলেই তিনি ঘাবড়ে যেতেন। ঘিরে ধরত ‘Anxiety attack’। তাই মন খুলে গান গাইতে সমস্যা হত তাঁর। যদি আজকের মত আত্মবিশ্বাসী থাকতেন তিনি, তাহলে সেই সময়ে হয়ত আরও ভালো ফল পাওয়া যেত। এবং অবসাদে, তাঁর শরীরেরও কোনও ক্ষতি হত না।
ইন্ডিয়ান আইডলের মঞ্চে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় মায়ান চ্যাঙের। সেই আলাপ, প্রণয়ে পরিণত হয়। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে, পূর্ণতা পায়নি তাঁদের সম্পর্ক।
মোনালির জীবনে আসেন নতুন মানুষ। নতুন সুরের বাঁধনে গায়িকার সঙ্গে আবদ্ধ হন মাইক রিচার। সেই সম্পর্ককে তাড়াতাড়ি পূর্ণতা দিতে একে অপরের সঙ্গে সাত পাকে বাঁধা পড়েন তাঁরা। কিন্তু সেই সফরেও আসে নানা রকম সংঘাত।
সুইজারল্যান্ড নিবাসী মাইক, এক ব্যক্তির দ্বারা বিপথগামী হয়ে ভারতে মোনালিকে বিয়ে করতে আসেন ভিসা ছাড়াই। যদিও জার্মান পাসপোর্ট ছিল তাঁর কাছে।
কিন্তু তা কোনও উপকারে আসেনি তাঁর। ফলে এয়ারপোর্টে তাঁকে আটকে রাখা হয় মাইককে। অপরদিকে রেজিস্ট্রেশন অফিসে কনে বেশে হবু বরের জন্য অপেক্ষারত ছিলেন বড় পর্দার ‘Lakshmi’।
বিবাহের পর থেকেই মোনালি সুইজারল্যান্ডবাসী। নিজের মত গুছিয়ে নিয়েছেন তাঁর সংসার। তবুও, এক বড় গভীর ক্ষত তাঁকে আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। অতিমারির পরিস্থিতিতে বাবা শক্তি ঠাকুরকে হারান গায়িকা। লকডাউনের ঘেরাটোপ অতিক্রম করে, শেষ বারের জন্যও দেখতে পারেননি তাঁর জীবনের ভিতকে।
যেকোনও সফল শিল্পীর সাফল্যের সঙ্গে দোসর হয় সমালোচনাও। মাস কয়েক আগে মোনালি শিরোনামে এসেছিলেন তাঁর চেহারার কারণে। নেটিজেনদের দাবি, সার্জারি করিয়েছেন মোনালি। যদিও এইসব নিয়ে একদমই চিন্তিত নন গায়িকা। বরং তিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে প্রাণ ভরে বেঁচে নিতেই মগ্ন থাকেন।
তিনি তাঁর নীরবতা দিয়ে প্রমাণ করেছেন, শিল্পীর ধর্ম হল কাজ। এবং প্রত্যেক মানুষেরই অধিকার আছে নিজের মত করে, নিজের আনন্দে বাঁচার। তাই কে কী নেতিবাচক মন্তব্য করলেন, সেগুলিকে পাশে সরিয়ে রেখে এগিয়ে যেতে হবে আগামীর পথে। আনন্দে, উচ্ছ্বাসে বাঁচতে হবে, প্রতিটি মুহূর্ত।