উদ্বাস্তু নারী থেকে ব্র্যান্ড-বুড়িমা! বিড়ির কারখানা থেকে আলতা সিঁদুর কোনো ক্ষেত্রেই নাম বাদ যায়নি তার, তবে কে এই বুড়িমা?
কালীপুজোর রাত মানেই বাজি। বাজি ছাড়া আট থেকে আশি সবারই কালীপুজোর রাত অচল। বিশেষ করে আশি নব্বই দশকে বড় হয়ে ওঠা মানুষেরা এই বাজির সাথে ওতপ্রোত জড়িত। এই বাজি দুনিয়াতেই বিখ্যাত বুড়িমা। আশি নব্বই দশকের মানুষেরা এক কথায় বলেন বুড়িমার চকলেট বোম। তবে বেশিরভাগ মানুষেরই কোন আইডিয়া নেই কে এই বুড়িমা! কোথা থেকে এলো এই ব্র্যান্ড নেম!
এর পক্ষে তথ্য খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে বিখ্যাত বুড়িমার নাম অন্নপূর্ণা দাস। তার জন্ম ফরিদপুরে। দেশভাগের পর উদ্বাস্তু হয়ে যায় মেয়েটি। তারপরেই তিল তিল করে গড়ে তোলে এই ব্রান্ড। দেশভাগের পর বুড়িমার জায়গা হয় ধলদিঘি সরকারি ক্যাম্পে। তাই এই বুড়িমার ব্র্যান্ড স্রেফ একটা বাজি নয়, এক বাঙালি মেয়ের উত্থানগাথাও।
দাঙ্গা বিধ্বস্ত পূর্ব পাকিস্তান থেকে যখন ১৯৪৮ সালে এই শহরে আসেন, তখন তার কোলে তিন সন্তান। সেইদিন সন্তানদের রক্ষা করতে তাদের ভরণপোষণ এর দায়িত্ব নিয়ে তাকে একাই দশভূজা হয়ে লড়াই করতে হয়। সমস্ত গ্লানি ঝেড়ে ফেলে দারিদ্রতার সাথে লড়াই করে উঠছে ঝিঙে পটল মুলো সবই বিক্রি করতে থাকেন বাজারে। নির্দ্বিধায় বিড়ি বাধাইয়ের কাজও করেছেন দিনমজুরিতে। রক্ত জল করা সেই উপার্জন দিয়ে ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছেন একটি বিড়ির কারখানা।
পরে বেলুড়ে এসে তিনি পুঁজি বাড়িয়ে আলতা সিঁদুর এর ব্যবসা শুরু করেছেন। ততদিনে মেয়ের বিয়ে হয়েছে, বাড়ি হয়েছে, চুল পেকেছে। একটি দোকান ও হয়েছে। নাম অন্নপূর্ণা। তবে ছেলেমেয়েরা তার কাছে বাজে কিনতে এলে তিনি শুনতে পেতেন চালু লজ্জ বুড়িমার বাজি। ততদিনে তিনি বুঝতে পারেন যে বাজে অন্য জায়গা থেকে কিনে এনে বিক্রি করার চেয়ে নিজে বানিয়ে বিক্রি করায় লাভ হবে অনেক। এই ভেবেই তিনি ছেলে সুধীরনাথকে সামনে রেখে সরকারি নিয়ম নীতি মেনেই শুরু করেন বাজি ব্যবসা।
তারপরে শিখে নেন বাজি তৈরি। ছেলে সুধীরনাথ শিখে নেন চকলেট বোম তৈরি। সেই যে শুরু তারপর থেকে তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বাঙালির বুড়ি মাকে ছাড়া তারপর থেকে আর একদিনও চলেনি। ভারত পাকিস্তান ম্যাচ হোক কিংবা দীপাবলি সমস্ত ক্ষেত্রেই বুড়িমা বিরাজিত। তবে তিনি শুধু বাংলাতেই আটকে থাকেননি বাংলা ছেড়ে পাড়ি দিয়েছেন তামিলনাড়ুতে। সেখানে রয়েছে তার একটি দেসলাই কারখানাও।
নব্বইয়ের দশকে মৃত্যু হয় বুড়িমার। এই দশকের শেষদিকে শুরু হয় শব্দবাজি নিয়ন্ত্রণ আইন। তখন সালটা ১৯৯৬। বুড়িমার ব্যবসায় আসে ভাটা। অবশ্য ততদিনে অন্নপূর্ণা দেবীর মৃত্যু হয়েছে। তবে কথায় আছে সব মরণ সমান নয়… এক উদ্বাস্তু নারীর এই কাহিনী প্রেরণা জোগায় হাজার হাজার নারীকে।