‘সুচিত্রা নায়িকা হলে আমার হাতের তালুতে চুল গজাবে’, বলেছিলেন এক বড় পরিচালক! গৃহিণী থেকে মহানায়িকা, রইল সুচিত্রা সেনের জীবন কাহিনী
সুচিত্রা সেন, যার কথা ভাবলেই চোখের সামনে উঠে আসে কপালে কালো টিপ, মাঝ বরাবর সিঁথি করা, তাঁতের শাড়ি পরা এক ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট এক যুবতী নারীর প্রতিচ্ছবি। মহানায়িকা বলতে বাংলা সিনেমা জগৎ এখনো তাকেই বোঝে। বাংলা চলচ্চিত্র জগতের একজন অন্যতম কিংবদন্তি নায়িকা। তার জায়গায় এখনো পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেননি কোন অভিনেত্রীরাই।
কবি রজনীকান্ত সেনের নাম কারোরই অজানা নয়। তাঁরই নাতনি ছিলেন রমা সেন। যাকে সবাই সুচিত্রা সেন নামে চেনেন। প্রথমে তিনি স্বামীর হাত ধরে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলেন সিনেমার জন্য। তবে সিনেমার জন্য ইন্টারভিউ দিতে গেলে প্রথমেই তার কর্মজীবনের বাধা হিসেবে দাঁড়ায় ‘শব্দের উচ্চারণ।’
এক বড় পরিচালক তাকে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, “দেখব রমা কিভাবে হিরোইন হয়! যদি হয়তো আমার হাতের তালুতে চুল গজাবে।” তবে নিজেকে প্রমাণ করতে নায়িকার বেশি সময় লাগেনি। তিনি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয় সেই পরিচালককে বলেছিলেন, “দেখে দেখি আপনার হাতটি কোথায়? হাতের তালুতে চুল গজানোর কথা ছিল তো! আমিতো হিরোইন হয়ে গেছি।”
সত্যভাষী এই মানুষটি অভিনয়ের পথচলা শুরু হয়েছিল স্বামীর হাত ধরেই, নিজের থেকে স্বামী এবং স্বামীর পরিবারের উৎসাহ ছিল সব থেকে বেশি। তবে এরপরেও অভিনেত্রীর সংসারও বেশি দিন টেকেনি, অভিনয় কারণের জন্যই কিনা তা এখনও জানা যায়নি।
১৯৫১ সালে পরিচালক সুকুমার রায়ের সাথে প্রথম কাজ করেন অভিনেত্রী। ‘১৯৫১ সালে সাত নম্বর কয়েদী’ সিনেমার মধ্যে দিয়ে আত্মপ্রকাশ ঘটে তার। তারপর স্বামীর সাথেই এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ ছেড়ে একেবারে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় চলে আসেন অভিনেত্রী। তারপর টলিউডের ‘শেষ কথায়’ সিনেমাতে নায়িকারূপে তিনি পথ চলা শুরু করেন। তবে সেই সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়নি।
অভিনয় প্রবেশের পরেই তিনি নাম বদলান। ১৯৫৩ সালে সাড়ে চুয়াত্তর ছবিতে মহানায়ক উত্তম কুমারের বিপরীতে কাজ করেন তিনি। সেই সিনেমায় অভিনয় এতটাই বাস্তবসম্মত ছিল যে দর্শকের মনে পাকাপোক্ত জায়গা করে নেন উত্তম-সুচিত্রা জুটি। তারপরেই এই জুটি বাংলার সেরা জুটি হয়ে ওঠে। তাদের এই জুটি দেখে দর্শকরা এতটাই একাত্ম বোধ করতেন কখনো তাদের জুটি সম্পর্কে প্রেমের সম্পর্ক আবার কখনো দাম্পত্য জীবনের গল্পও শোনা গেছে তাদের নিয়ে।
১৯৫৪ সালে পরপর ৯ টি ছবিতে অভিনয়ের জন্য সই করেছিলেন সুচিত্রা সেন। তারপর ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত একের পর এক হিট ছবি দর্শকদের উপহার দিয়েছেন সুচিত্রা সেন। তৎকালীন সমাজে প্রচলিত গৃহবধূর তকমা ভেঙে আদর্শ মহানায়িকা হয়ে উঠেছিলেন তিনি। শুধু শাড়িতেই থেমে থাকেননি অভিনেত্রী, সেই সময় তাঁর ফ্যাশন স্টেটমেন্ট সেরা সেরা আইকনের তকমা পেয়েছিল।
সেই সময় সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা মোবাইল ফোন কিছুই ছিল না। অভিনেত্রীর বিভিন্ন লাস্যময়ী ছবি প্রকাশিত হতো বিভিন্ন ম্যাগাজিনে বা বিভিন্ন পত্রিকায়। কখনো ইন্দো ওয়েস্টার্ন আবার কখনো সাবেকিয়ানা সব সাজেই একেবারে বাজিমাত করেছেন তিনি। কখনো চোখে রোদ চশমা আবার কখনো মাথায় বড় টুপি কিছুই বাদ যায়নি।
তবে হঠাৎই তিনি ক্যামেরার আড়ালে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তবে এর কারণ আজ পর্যন্ত জানা যায় নি। অনেক বিশেষজ্ঞ মহল মনে তার শেষ ছবি প্রণয়পাশা’ ফ্লপ হওয়ার একমাত্র কারণ। তবে এ ব্যাপারে সদুত্তর আজও মেলেনি। ২০০৫ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে পুরস্কৃত করার জন্য মনোনীত করা হয়েছিল সুচিত্রা সেনকে, কিন্তু ভারতের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে সশরীরে পুরস্কার শর্ত ছিল।
তবে তিনি জনসমক্ষে আসবেন না বলে দিল্লি যাওয়ার প্রবল আপত্তি ছিল তার। দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারটি হাতে তুলে দেয়া হয়নি। ২০১৪ সালের ১৭ ই জানুয়ারি সকাল ৮ টা ২৫ মিনিট নাগাদ কলকাতার জনপ্রিয় বেলভিউ হাসপাতালে হূদরোগে আক্রান্ত হন তিনি। এর পরেই সকলের প্রিয় মহানায়িকা বিদায় নেন।