রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু দিনে পাশে থাকতে পারেনি পুত্র রথীন্দ্রনাথ, নিমতলায় পৌঁছোতেই পারেননি কবিপুত্র! তাহলে মুখাগ্নি করেছিলেন কে?
দিনটা ছিল বাইশে শ্রাবণ। ইংরেজি ক্যালেন্ডার হিসেবে ১৯৪১ সালের ৭ই আগস্ট। সারাবিশ্ব যেন এই দিন টিতে থেমে গিয়েছিল, আশঙ্কা করছিল কোন ঝড়ের। সবকিছুই স্বাভাবিকভাবে চললেও উত্তর কলকাতার তথা সারা বাঙালি এবং ভারতবর্ষের একটি জ্বলন্ত প্রদীপ যেন নিভে গেল সেদিন। যে মানুষটি বারবার নিজের কবিতা গানের মাধ্যমে মৃত্যুকে দেখেছেন অনুভব করেছেন সেই মানুষটি চিরতরে নিঃশ্বাস ত্যাগ করে ইহকাল থেকে পরকালে গমন করলেন। চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল তার হৃদস্পন্দন। মৃত্যু হল হাজারো বাঙালির প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের।
শেষবারের মতো নিজের হাতে গোছানো স্বপ্নের জায়গা শান্তিনিকেতন ঘুরে দেখার ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারেনি সে। তার সাধের জায়গাটা শেষবারের মতো ঘুরে দেখা হলো না আর তার। সেই একবুক আক্ষেপ নিয়ে চলে যেতে হয়েছিল তাঁকে। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথকে এই কথাগুলো বারবার ভাবাতো সঙ্গে ছিল প্রশান্ত মহলানবিশের স্ত্রী নির্মলকুমারী। সারা জোড়াসাঁকো যখন ভারাক্রান্ত তখনই একের পর এক লোক এসে নির্মলকুমারী কে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতে থাকলো, তবে শেষ বয়সে তিনি রবীন্দ্রনাথের সমস্ত ইচ্ছের কথা জানতেন তার দায়িত্ব ছিল রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছে গুলো পূরণ করার। এরপরই হঠাৎ ফোন এসেছিল গুপ্ত নিবাস থেকে।
সেখানে তখন থাকতেন মহলানবিশরা। ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি করে জোড়াসাঁকো পৌছলেন তারা। ততক্ষনে রবি ঠাকুরের মৃতদেহ স্নান করানো হয়েছে। এরপরে মৃতদেহ কে সাজিয়ে বিছানায় শয়ন করানো হয়েছে, ঠিক তখনই একদল লোক হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে রবি ঠাকুরের মৃতদেহ তুলে নিয়ে গেলে। আশেপাশের লোকজন বলতে থাকলো কোন শিষ্টাচার নেই এতটুকু সম্মান করলোনা বিশ্বকবির। বাইরে তখন জয়ধ্বনি শোনা যাচ্ছে ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জয়’, ‘জয় বিশ্বকবির জয়’। সেই জয়ধ্বনী জোড়াসাঁকোর ভিতরে থাকা মানুষগুলির মনে সূচের মতো বিঁধে ছিল। সেই সময় ওই পরিস্থিতিতে বিভ্রান্ত সৃষ্টি করেছিল সজনীকান্ত দাসের বয়ানও। সেই বয়ানে তিনি বলেছেন এমন কোন ঘটনা সেইদিন ঘটেনি মিথ্যে গুজব রটানো হয়েছিল কিন্তু সেই গুজব রটানো কারণ আজও জানা যায়নি।
রবীন্দ্রনাথের শেষ যাত্রার বর্ণনা বিভিন্ন জায়গায় শোনা গিয়েছে একথা সত্য যে রবীন্দ্রনাথের মরদেহ সেইদিন মাটি স্পর্শ করেনি, তার পাশাপাশি একথাও সত্য তার মরদেহের উপরে বিভিন্ন রকমের অত্যাচার চলেছে কেউ কেউ তার চুল দাড়ি ছেড়ে নিয়েছে, কেউ কেউ প্রণামের অজুহাতে তুলে নিয়েছে তার পায়ের নখ। গোটা রাস্তা সেইদিন লোকে-লোকারণ্য বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন লোক এসেছিলেন সেই দিন। তবে এইসব এর মাঝেও আসতে পারেনি রথীন্দ্রনাথ। না বাবার শেষ দিনে শেষ মুখাগ্নি টুকু করতে পারেনি রথীন্দ্রনাথ। নিমতলা শ্মশান ঘাটে সেইদিন লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ের মাঝে রথীন্দ্রনাথ বাবার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেও পৌঁছতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথের ছেলে এসেছে শুনে তাকে দেখার জন্য হাজারো মানুষের ভিড় জমে গেল তার চারিপাশে, এত লোকের মাঝে তিনি জ্ঞান হারালেন।
রবীন্দ্রনাথের শোভাযাত্রা শুরু হয় বিকেল তিনটের থেকে এবং শেষ হয় রাত আটটায় নিমতলা শ্মশান ঘাটে। শেষকৃত্য সম্পন্ন করেছিলেন ঠাকুর বংশের পৌত্র সুবীরেন্দ্রনাথ ঠাকুর। নিমতলা শ্মশান ঘাটের যে স্থানে রবীন্দ্রনাথকে দাহ করা হয়েছিল সেখানে আজও তার নামে একটি স্মৃতিফলক রাখা রয়েছে। তাতে লেখা রয়েছে – ‘অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে/সে পায় তোমার হাতে/শান্তির অক্ষয় অধিকার’। বিশ্বকবির ইচ্ছে ছিল তাঁর মৃত্যুর পরে এই গান গাওয়া হোক। তাই আজও স্মৃতির ফলকে তার এই গানের লাইন লেখা রয়েছে।
তথ্যসূত্র-
১। বাইশে শ্রাবণ- নির্মলকুমারী মহলানবিশ
২। শনিবারের চিঠি, ১৩শ বর্ষ, ১১শ সংখ্যা, ভাদ্র ১৩৪৮
৩। ১। গুরুদেব- রানী চন্দ