প্রথম ‘মিস ইন্ডিয়া’, তবুও বয়ে বেড়িয়েছেন পাকিস্তানের গুপ্তচর অপবাদের তকমা! কলকাতার এক অজানা মেয়ের কাহিনী
এস্টার ভিক্টোরিয়া আব্রাহাম! না মনে নেই কারোরই। কি করেই বা থাকবে কলকাতা মনে রাখতে চেয়েছে নাকি তাকে। কলকাতাবাসীদের কাছে এই অপ্সরা অধরাই রয়েছেন। জানেনই না কলকাতাবাসীরা কে তিনি! কিইবা তার আসল পরিচয়!এদিকে কলকাতার পুরনো ইতিহাস খুঁজে বার করলে পাওয়া যায় এই নারীর অস্তিত্ব।
জন্ম: ৩০ শে ডিসেম্বর ১৯১৬ সালে। রক্ষণশীল বাগদাদী ইহুদি পরিবারে জন্ম তার। বাবা ছিলেন কলকাতার বড় ব্যবসায়ী তবে বাবার ছিল দুটো বিয়ে। বাবার আগের পরিবারের সন্তান এবং নিজের দুই ভাই বোনের সাথে থাকতেন তিনি। একেই মেয়ে হয়ে জন্মেছেন তার মধ্যে তার পরিবার তৎকালীন সমাজের পুরনো ধ্যান ধারনা নিয়েই বাঁচত। তাই নিজের মতো করে বাঁচার কোন পরিসরে ছিল না তার কাছে।
পড়াশোনা শুরু করেন ক্যালকাটা গার্লস স্কুল থেকে এবং পরে সেন্ট জেমস স্কুলে পড়াশোনা করেন। খেলাধুলা থেকে শুরু করে নাচ-গানে ও তিনি ছিলেন তুখোড়। খেলাধুলায় ছেলেদের হারিয়ে দিতেন তিনি, অপরদিকে নাচ-গানে ও অন্যান্য মেয়েদের থেকে ছিলেন এগিয়ে। তিনি ছিলেন একজন হকি চ্যাম্পিয়ন তার সাথে সাথে আক্রারহাট এতো ভাল ছিল যে কলা শিল্পের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী পান।
তবে পড়াশোনা শেষ করে মন্টেসরি স্কুলের দিদিমণি হতে চেয়ে ছিলেন তিনি। তবে তার কপালে ছিল অন্য জগতের হাতছানি। তবে পরিবার রক্ষণশীল হলেও নাচ-গানে বেজায় আগ্রহ ছিল পরিবারের। নাচের জগৎ থেকেই তিনি পা রেখেছিলেন থিয়েটার জগতে। সেখানেই এক মাড়োয়ারি থিয়েটার অভিনেতার সঙ্গে প্রণয় থেকে শুভ পরিণয় সম্পন্ন হয় তাদের। কোল আলো করে আসে পুত্রসন্তান মরিস। তবে সে বিয়ে টেকেনি বেশিদিন। অগত্যা মরিসের দায়িত্ব নিতে হয় এসটার এর বাবা মাকেই।
খুড়তুতো বোন রোজ এর সাথে দেখা করতে বোম্বে গিয়েছিলেন তিনি। তখন তার বোন ফিল্মি লাইনের কাজ করছেন। তবে হঠাৎই পরিচালকের চোখে পড়েন তিনি। পরিচালক তাঁর মুভি ‘দ্য রিটার্ন অফ দা তুফান মেল’ থেকে বাদ দিয়ে দেন রোজকে। নতুন কাস্টিং করেন এস্টারকে। অদ্ভুত ভাবেই তিনি ফিল্মি লাইনে প্রবেশ করে গিয়েছিলেন তার পরেই। তারপর থেকে বোম্বেতে বসবাস শুরু করলেন তিনি। পরিচালক প্রযোজকরা মিলে তার নতুন নাম দিলেন প্রমিলা। সেই নামেই তিনি হাজার হাজার খ্যাতি অর্জন করলেন। তারপরে নাটক কিংবা প্রোজেক্টের পরিবর্তনের বিরতিতে ১৫ মিনিটের নাচের অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে দর্শকের মনোরঞ্জন করতে শুরু করলেন। সুনাম অর্জন করেছিলেন স্টান্ট অভিনেতা হিসেবেও। ‘উল্টি গঙ্গা’,’জঙ্গল কিং’,’বিজলি’ অদৃশ্য ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। টানা দুই দশক ধরে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন।
১৯৪৭ সালে প্রথম মিস ইন্ডিয়া খেতাব জেতেন। তবে ৩১ বছরের প্রমিলা ছিলেন গর্ভবতী। তবে প্রতিযোগীদের ফিগারের থেকেও মুখশ্রীর ওপর বেশি জোর দেয়া হতো সেই সময়। সুন্দর চোখ মুখের গড়নের মহিমায় ছিনিয়ে নেন ভারত সুন্দরীর মুকুট। তিনিও তার বাবার মতোই দুইবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন সহকর্মী সৈয়দ হাসান আলী জায়েদীরকে। যিনি ফিল্ম জগতে পরিচিত ছিলেন কুমার নামে। মুঘল-ই-আজম, শ্রী ৪২০ প্রকৃতির চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি।
প্রথম মহিলা প্রযোজিকা হিসাবে নিজেই নাম লেখান। স্বামীর সাথে কাঁধ মিলিয়ে নিজেই হলেন প্রোডাকশন হাউজ। তার কোম্পানির প্রযোজনায় নির্মিত হয়েছিল মোট ১৬ টি চলচ্চিত্র। এমনকি ফ্যাশন আইকন থেকে সিনে পত্রিকার সেরা সাহসী মডেল হিসেবেও যথেষ্ট নাম খ্যাতি ছিল তার।
তবে প্রমীলার দ্বিতীয় বর এক সময় নিজের প্রথম পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত নেয়া মতোই তিনি পাকিস্তান চলে যান। তবে পাকিস্তানে চলে গেলেও প্রমিলা দেবী নিজের সন্তানদের নিয়ে ভারতেই থেকে যান। তবে মোরারাজি দেশি তাকে পাকিস্তানের গুপ্তচর বলে অভিযোগ করেন। সেই খুবই জঘন্য ভাবে ফেঁসে যান অভিনেত্রী। প্রমিলা নিয়মিতভাবে পাকিস্তান যেতেন। তাই সব গুপ্ত খবর পাকিস্তানের চালান করার অভিযোগে অভিযুক্ত হন তিনি। পরে অবশ্য তা প্রমাণ হয়ে যায় যে তিনি তার নিজের চলচ্চিত্রের প্রচারের জন্যই পাকিস্তান যেতেন।
২০ বছর পর তার মেয়েও মিস ইন্ডিয়ার মুকুট মাথায় তুলে নেন। এখনো অব্দি কোন মা মেয়ে দুজনেই ইন্ডিয়া খেতাবের অধিকারী হন নি। যা সত্যিই বিরল এক ঐতিহাসিক ঘটনা। প্রমীলা দেবীর ছোট ছেলে হায়দার আলী একজন লেখক। বিখ্যাত সিনেমা যোদ্ধা আকবর এর চিত্রনাট্য তাঁরই লেখা। প্রমীলা দেবীর শেষ ছবি থাং। যা মুক্তি পায় ২০০৬ সালে। সেই বছরের এই ৬ ই আগস্ট তিনি পরলোকগমন করেন। তখন তার বয়স হয়েছিল ৯০ বছর।